সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকার বহু মানুষের জীবন-জীবিকার অন্যতম প্রধান উৎস হচ্ছে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। জীবিকার সন্ধানে সুন্দরবনে গিয়ে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন উপকূলের অসংখ্য মানুষ। এতে বিধবা হয়েছে তাদের স্ত্রী। যাদেরকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় ‘বাঘ-বিধবা’। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপকূলে এমন হাজারো ‘বাঘ-বিধবা’ রয়েছেন, যাদের হিসাব নেই সরকারি খাতায়।
বাঘের প্রাকৃতিক আবাস রক্ষা এবং বাঘ সংরক্ষণের জন্য মানুষের সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে প্রতি বছরের ২৯ জুলাই পালন করা হয় বিশ্ব বাঘ দিবস। ‘মানুষ-বাঘের সুরেলা সহাবস্থান’ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে বাঘের বংশবৃদ্ধির অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) পালিত হয় দিবসটি। প্রতিবছর ঘটা করে বিশ্ব বাঘ দিবস পালন করা হলেও উপকূলের বাঘ বিধবাদের কেউ খোঁজ রাখে না। জীবিকার সন্ধানে সুন্দরবনে গিয়ে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের স্ত্রী’রা অপয়া, অলক্ষ্মী অপবাদ নিয়ে সমাজে চরম অবহেলিত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
শ্যামনগর উপকূলের গাবুরা, মুন্সীগঞ্জ, বুড়িগোয়ালিনী, কৈখালী, রমজাননগর, আটুলিয়াসহ উপকূলঘেঁষা গ্রামগুলোতে এমন শত শত নারী আছেন, যাদের অনেকের স্বামী সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়ে বাঘের আক্রমণের শিকার হয়েছেন, কেউবা মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে। এতে কোন ভূমিকা না থাকলেও এসব বিধবা নারীর কপালে জুটেছে অপয়া, অলক্ষ্মী, স্বামীখেকো আর ডাইনির মতো অপবাদ। তাদের জন্য নেই কোনো সহানুভূতি, সান্তনা, কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি।
শ্যামনগরের মুন্সীগঞ্জ জেলেপাড়ার আলোচিত নাম সোনামণি দাসী (৬৮)। ১৯৯৯ সালে সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে মারা যান তার স্বামী রাধাকান্ত সরদার। সঙ্গীরা তার লাশও খুঁজে পাননি। স্বামী হারানোর শোকে যখন তিনি মুহ্যমান, তখন তার কোলে ছিল এক মাস বয়সী সন্তান। অথচ শাশুড়ি তাকে অপয়া অপবাদ দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। বাবার বাড়িতেও ঠাঁই হয়নি তার। অপমান আর চোখের অশ্রুকে সঙ্গী করে থাকতে হয়েছে দেবরের ঘরে। এরপর দেবর ভূবেন সরদারের সঙ্গে তার দ্বিতীয় বিয়ে হয়। তখন কিছুটা আশার আলো দেখেছিলেন। কিন্তু ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার পরপরই ভূবেনও সুন্দরবনে গিয়ে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারান। তার লাশও পাওয়া যায়নি।
দ্বিতীয়বার বিধবা হয়ে সোনামণি অকুল পাথারে পড়েন। পেট চালাতে তিনি নিজেই কাজে নামেন। মাছ ধরেন, মানুষের বাড়িতে কাজ করেন, মাটি কাটেন। মেয়েদের বিয়ে দেন। এখন বয়সের ভারে এসব কাজ আর করতে পারেন না। বলেন, এ জীবন তো মৃত্যুর মতোই। স্বামী বাঘের পেটে গেল আর আমাকেও রেখে গেল মরার মতো। এখন লোকের বাড়ি ঝি’য়ের কাজ কখনো বাজারের দোকানে কাজ করে কোন রকমে বেঁচে আছি। সোনামণির অভিযোগ, সরকার থেকে তাকেসহ তার প্রতিবেশী আরও তিনজনকে কোনো সহযোগিতা করা হয়নি।
মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের জেলেপাড়ায় বাসিন্দা বলি দাশী। তার অবস্থাও সোনামণির মতো। ২০০২ সালে তার স্বামী অরুণ মন্ডল বাঘের আক্রমণে মারা যান। তাকেও স্বামীর মৃত্যুর পর ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, আমাকে শ্বাশুড়ি ঘর থেকে তাড়িয়ে দিল। ভাইয়ের বাড়িতে জায়গা পেলাম ঠিকই, কিন্তু সে জীবন বড় যন্ত্রণার। পরে নদীতে রেণুপোনা ধরে সন্তানদের বড় করেছি। আজও একই কাজ করে জীবন চালাই। তার দেবরও একইভাবে বাঘের আক্রমণের শিকার হন।
শুধু এ দুজনই নয়- শ্যামনগরের উপকূলীয় এলাকার প্রতিটি গ্রামে এমন অনেক সোনামণিদের দেখা মেলে। একেকটি মুখ যেন একেকটি গল্প। তাদের সবার জীবন কাটছে অপবাদ আর দারিদ্র্যকে সঙ্গী করে।
বেসরকারি সংস্থা লিডার্স জানিয়েছে, উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ১ হাজার ১৬৩ জন ‘বাঘ-বিধবা’ আছেন। এর মধ্যে গাবুরায় ১০৯ জন, বুড়িগোয়ালিনীতে ৩৯ জন, মুন্সীগঞ্জে ১০৭ জন, রমজাননগরে ৪১ জনসহ সুন্দরবনসংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায় বাঘ-বিধবারা থাকেন। অন্যদিকে সরকারি হিসাবে স্বীকৃত ‘বাঘ-বিধবা’র সংখ্যা মাত্র সাতজন।
উপকূলের বাঘ-বিধবাদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন উন্নয়নকর্মী পীযুষ বাওয়ালিয়া পিন্টু। তিনি বলেন বনবিভাগের পাশ নিয়ে বৈধভাবে সুন্দরবনে গিয়ে বাঘের আক্রমণে নিহত হলে তাদের তালিকা সরকারিভাবে সংরক্ষন করা হয়। তার মতে, আগে বাঘের আক্রমণে আহতদের ৫০ হাজার আর নিহতদের ক্ষতিপূরণ ১ লাখ টাকা ছিল। এখন সেটা ৩ লাখ হয়েছে। আহত হলে ১ লাখ। কিন্তু যারা অন্যের পাসে বা অবৈধভাবে বনে যান, তারা কোনো ক্ষতিপূরণ পান না।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোছা. রনী খাতুন জানান, সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় যেসব বাঘ-বিধবা আছেন তাদের ভাতার ব্যাপারে আগে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা সমাজসেবা কর্মকর্তাকে জানিয়েছি। ইতোমধ্যে তাদের ১৭ জন বাঘ বিধবাকে সুপেয় পানি নিশ্চিতে ৩ হাজার লিটারের পানির ট্যাংকি দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও সরকারের পক্ষ থেকে উপজেলা প্রশাসন তাদের পুনর্বাসনে উদ্যোগ নেবে। তা ছাড়া কিছু এনজিও তাদের নিয়ে কাজ করছে।
খুলনা গেজেট/এসএস